December 23, 2024, 3:44 am
দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদক/
প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া চক্রের প্রধান অর্থ লগ্নীকারী হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মহিবুল ইসলাম এবার নাড়িয়ে দিয়েছে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী রাজনীতিকে। বের করে দিয়েছে এর ভেতরের চরমতম দূর্গন্ধ চিত্রটা। বারবার জেলার অসংখ্য পুরোন, নতুন, হাইব্রিড এরকম অনেক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে শত অপকর্মের কথা উঠলেও কিছুই হয়নি এদের। বরং যারা বলতে গেছে তাদেরকেই শিকার হতে হয়েছে নানা হয়রানির। এবার একটি বড় বোমা ফাটলো মহিবুলের কুষ্টিয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য প্রদানের মাধ্যমে। জেলার দীর্ঘ পরিচিত একজন রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে। যদিও তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ নতুন নয়। কারন মোহিনী মিল না থাকলেও মিলের স্মৃতিটুকু এখনও আছে। তবে হালের অভিযোগ কতটুকু সত্য হয় সেটার উপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।
অন্যদিকে যার উপর নির্ভর করে এই জেলার রাজনীতি তার সাথেও কথা হয়। তিনি জানান পরিস্থিতি বিবেচনা করে জেলা আওয়ামী লীগই এ বিষয়ে সিদ্দান্ত নেবে।
মহিবুলের ভাষ্যমতে ঐ সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে ৭৭ লাখ টাকার যে হিসেব সামনে এসেছে এটা ছিল মুলত তার লগ্নী। বরং সম্পত্তি করতলগত করার পর বিক্রি করে যে বিশাল অংকের টাকা আসবে সেটাই মুল হিসেব। আর এসব করতে যার সাহায্য নেয়া হয়েছে তিনি হলেন জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজি রবিউল ইসলাম। হাজি রবিউল এই জমি হাতানোর পর কোনো সমস্যা হলে তা দেখবেন বলে মহিবুলকে আশ্বস্ত করেন। এ জন্য মহিবুল তাকে ৩০ লাখ টাকাও দেন বলে জবানবন্দিতে দাবি করেছেন।
তবে দৈনিক কুষ্টিয়ার পক্ষ থেকে হাজি রবিউল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কারন তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পুলিশ এ ব্যাপারে মুখ না খুললেও একাধিক সূত্র জানায়, মহিবুল তার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, এ জালিয়াত চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন হাজি রবিউল ইসলাম। তার সঙ্গে আরও সাত-আটজন ছিলেন। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতিসহ অন্য কাজ আগেই করে রাখেন।
মহিবুল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি একজন ব্যবসায়ী। ২০১৭ সালের শেষ দিকে হরিপুরের সাবেক মেম্বার হালিম উদ্দিন, মজমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার আসাদুর রহমান বাবু, রাজু আহম্মেদ ও লাহিনী এলাকার জাহিদুল তার কাছে আসেন। তাদের সঙ্গে প্রথমবার কুষ্টিয়া পৌরসভার পুকুরপাড়ে সভা হয়। সেখানে তারা জমির বিষয়টি জানান। এরপর তাকে জমি দেখানো হয়।
জবানবন্দিতে মহিবুল আরও জানান, এর ১৫ দিন পর তারা আবার তার কাছে একই স্থানে আসেন। ওই দিন কাবিল নামের নতুন একজন আসেন। জমি কেনাবেচার বিষয়ে আলোচনা চললেও দামদরের বিষয়টি ঝুলে থাকে। এর পর একই স্থানে তৃতীয় সভা হলে যুবলীগ নেতা সুজন ও হাজি রবিউল ইসলাম যোগ দেন। এই সুজন হ্েযলা হাজি রবিউলের আত্মীয়। ওই সভা থেকে ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। পরে তিনি (মহিবুল) তাতে রাজি হন। সেখানে হাজি রবিউল, সুজনসহ তাদের সহযোগীরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বসেই সব পরিকল্পনা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়া কীভাবে হবে, তার সব পরিকল্পনা করেন তারা। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ লাখ টাকা হাজি রবিউলকে দিতে হবে।
মহিবুল জবান বন্দিতে বলেন, জমি তার নামে রেজিস্ট্রি হলে তা আনুমানিক চার থেকে পাঁচ কোটি টাকায় বিক্রি করা হবে। ওই চক্রটি জানায়, তিনি ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা ফেরত পাবেন। এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা তাকে লাভ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট টাকা সবাই ভাগাভাগি করে নেবেন। এর পর মামলার ১০ নম্বর আসামি মহিবুল (ব্যবসায়ী মহিবুলের অধীনে চাকরি করতেন) জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তার নামে জমি রেজিস্ট্রি করে নেন। তবে মালিকপক্ষ হয়ে জাহিদ ও আসাদুর রহমান বাবু ব্যবসায়ী মহিবুলের কাছ থেকে ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা নেন। এ ছাড়া চুক্তিমতো হাজি রবিউলকে ৩০ লাখ টাকা দেন এই ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী মহিবুল জবানবন্দিতে বলেন, ওই জমি তার নামে বায়নানামা করে নেন। এরপর তিনি তার নামে নাম খারিজের জন্য আবেদন করেন। ১০ নম্বর আসামি মহিবুল তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হালিম উদ্দিনকে ওই জমি দেখাশোনার জন্য নিয়োগ করেন। জমির মূল মালিক মামলার বাদী ঘটনা টের পেয়ে নাম খারিজের বিপক্ষে আবেদন করলে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরে বিষয়টি ফাঁস হয়।
জবানবন্দিতে মহিবুল আরও বলেন, জমি ১০ নম্বর আসামি মহিবুলের নামে রেজিস্ট্রি হওয়ার পর সম্প্রতি তিনি (১০ নম্বর আসামি) তার নামে দলিল করে দেন। এর পর জমি অন্যখানে বিক্রির পরিকল্পনা ছিল। জমি বিক্রির পর কে কত টাকা পাবেন, তারও একটি তালিকা করা হয়। আর অগ্রিম ৩০ লাখ টাকা হাজি রবিউল তার কাছ থেকে নেন। এ ছাড়া জমির জন্য যারা ‘শ্রম’ দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই টাকা পান। জমি বিক্রি হলে যারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, তারাও গাড়িসহ নানা অঙ্কের টাকা পেতেন বলেও জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায়, এই ২২ শতাংশ জমির ভুয়া মালিক সেজে বিক্রি করে দেওয়ার পাশাপাশি এনএস রোডে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আবদুল ওয়াদুদের দোতলা বাড়িসহ প্রায় ১৭ কাঠা জমি একই কৌশলে বিক্রির চেষ্টা চালানো হয়। ওয়াদুদ ও তার পরিবারের অপর পাঁচ সদস্য এসব জমির প্রকৃত মালিক। জেলা নির্বাচন অফিসের সহায়তায় জালিয়াত চক্রটি ওই পরিবারের ছয় সদস্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের নকল তৈরি করে। এভাবে জমির মালিক বনে যায়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আকিবুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ী মহিবুল আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকের নামই এসেছে। বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আর যুবলীগ নেতা আশরাফুজ্জামান সুজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
জমির মূল মালিক এম এম ওয়াদুদ বলেন, থানায় ১৮ জনের নামে মামলা করেছি। এখন আরও অনেকের নাম আসছে। জবানবন্দিতে অনেকের বিষয় ও জড়িত থাকার কথা আমরা জানতে পারছি। চক্রটি বিশাল বড়। এ চক্রের মধ্যে হাজি রবিউলও থাকতে পারেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত না থাকলে এত বড় জালিয়াতি করা যায় না।
ওয়াদুদ বলেন, শহরে পৈতৃক সাড়ে চার বিঘা দামি সম্পত্তি রয়েছে। এ জমি বিক্রির কথা কখনও ভাবিনি। তারা আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে এমন কাজ করেছে। তাই এ চক্রের প্রত্যেকের কঠোর শাস্তি না হলে অনেকের সর্বনাশ হবে। কারণ, টাকা ও ক্ষমতার জোরে তারা এমন কাজ করেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি রবিউল ইসলামের জালিয়াতিতে সংশ্নিষ্টতার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, বিষয়টি লজ্জাজনক। দলের মধ্যে থেকে তিনি এমন কাজ করতে পারলেন, বিষয়টি ভাবতে পারছি না। দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে কোনো অপকর্ম করা যাবে না। যে-ই অপকর্ম করুক, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের নেতা মাহবুবউল-আলম হানিফ ছাড় দেবেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুবলীগ নেতা আশরাফুজ্জামান সুজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর জমি জালিয়াতির বিষয়ে হাজি রবিউলের নামও শোনা যাচ্ছিল। এর পর তিনি ঢাকায় চলে যান।
পুলিশ এ ঘটনায় এরই মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত জানান, যেহেতু এ মামলার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের বিষয় জড়িত, তাই অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে এই অবস্থায় নানা বিরুপ মন্তব্য করছে জেলা আওয়ামী লীগ ও অংগ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীরা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অভিযোগ করেছে জেলা আওয়ামী লীগ ও অংগ সংগঠনের মধ্যে এমন অসংখ্য নেতা আছেন যারা ঘাপটি মেরে বসে অসংখ্য অপকর্ম করে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। কারন মুখ খুললেই নেমে আসবে নির্যাতন, মামলা, হামলা। অনেকেই বরেছেন অতীতে এমন অনেক প্রমান আছে। মুখ খুলতে যেয়ে অনেককেই পদ হারাতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ জেলা আওয়ামী লীগের কোন র্শীষ নেতা।
(সংবাদটি তৈরি করতে দৈনিক সমকালে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রকাশিত সংবাদের সহায়তা নেয়া হয়েছে)
Leave a Reply